দ্বিতীয় অধ্যায় বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ -রচনাধর্মী বড়ো প্রশ্ন উত্তর

Language : Bengali

The Note contains Textual Question Answers from WBBSE Class 9 History Chapter 2 Biplobi Adorsho, Napoleonian Samrajjo o Jatiotabad ( দ্বিতীয় অধ্যায়  বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ ). Read the Question Answers carefully. This Question Answer set from the WBBSE board provides quality Multiple Choice Questions (MCQ), Short Answer Type Questions (SAQ), and Long Answer Type Questions from the above chapter. By reading these, students will get a clear idea about that chapter. It will enhance their knowledge and enable them to get good marks in the board exams. 

Class 9 History Chapter 2 Biplobi Adorsho, Napoleonian Samrajjo o Jatiotabad (বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ)

Short Answer Type Question (SAQ) from Biplobi Adorsho, Napoleonian Samrajjo o Jatiotabad

Long Answer Type Question from Biplobi Adorsho, Napoleonian Samrajjo o Jatiotabad,

নবম শ্রেণি ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ ,

নবম শ্রেণি বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ সম্পূর্ণ আলোচনা ও অনুশীলনীর প্রশ্নোত্তর,

নবম শ্রেণি ইতিহাস বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ থেকে সংক্ষিপ্ত, রচনাধর্মী ও ব্যাখ্যা ধর্মী প্রশ্নোত্তর 



দ্বিতীয় অধ্যায় বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ 


রচনাধর্মী বড়ো প্রশ্ন উত্তর :


1. নেপোলিয়ানের উত্থান ও ক্ষমতালাভ সম্পর্কে আলোচনা করো। 

আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়ক। যিনি এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজ প্রতিভার গুণে ফ্রান্সের শাসনভার দখল করেন। 

উত্থান - নেপোলিয়ান মাত্র 16 বছর বয়সে ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হন। এই সময় তিনি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে ফ্রান্সের তুলো বন্দর পুনরুদ্ধার করে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনি উন্মত্ত জনতার হাত থেকে ফ্রান্সকে রক্ষা করার জন্য মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। 

সামরিক সাফল্য - ডাইরেক্টরির শাসনকালে নেপোলিয়ান ইতালির সার্ভিনিয়া, নেপলস, পার্মা ও মডেনাকে পরাজিত করে। অষ্ট্রিয়াকে পরাজিত করে মিলান দখল করে। পোপের রাজ্যে আক্রমন করে পোপকে টলেন্টিনার সন্ধি সাক্ষরে বাধ্য করেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পিরামিডের যুদ্ধে জয়লাভ করলেও, নীলনদের যুদ্ধে পরাজিত হন। 

ক্ষমতা দখল - ডাইরেক্টরির শাসনকালে শাসন ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার সুযোগে নেপোলিয়ান সেনাবাহিনীর সহায়তায় ডাইরেক্টরির শাসকদের পদচ্যুত করে তিনি ফ্রান্সে কনস্যুলেটের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। তিনি প্রথমে 10 বছরের জন্য এবং পরে সংবিধান সংশোধন করে 1802 খ্রিষ্টাব্দে আজীবন কনসাল পদ লাভ করেন। 1804 খ্রিস্টাব্দে সম্রাট উপাধি গ্রহণের মাধ্যমে নেপোলিয়ান ফ্রান্সে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। 


2. নেপোলিয়ানের সংস্কার গুলি লেখ ?

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান শুধু সমরকুশলী যোদ্ধা হিসাবেই নয়।  সুদক্ষ সংস্কারক হিসেবেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।  ঐতিহাসিক ফিশার বলেছেন যে নেপোলিয়ানের সাম্রাজ্য ক্ষণস্থায়ী হলেও ফ্রান্সে তাঁর অসামরিক সংস্কারগুলি গ্রানাইট পাথরের শক্ত ভিতের উপর নির্মিত হয়েছিল। 

সংস্কার - 

i) শাসনতান্ত্রিক সংস্কার - নেপোলিয়ান ফ্রান্সে আইনের শাসন প্রবর্তন করেন এবং জনগণের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা দেন। তিনি সমগ্র দেশকে 83 টি ‘Department’ -এ ভাগ করেন। সেখানে ‘প্রিফেট’ নামে শাসক নিয়োগ করেন। তিনি প্রদেশ গুলিকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করে সেখানে ‘সাব-প্রিফেট’ নিয়োগ করেন। 

ii) অর্থনৈতিক সংস্কার - দেশের অর্থনৈতিক সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। 

a) তিনি সরকারি ব্যয় হ্রাস ও অডিট প্রথা চালু করেন। 

b) সবাইকে আয়কর দিতে বাধ্য করেন। 

c) নতুন কর না চাপিয়ে পুরানো কর আদায়ে জোর দেন। 

d) ‘ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। 

iii) শিক্ষা সংস্কার - নেপোলিয়ান ফ্রান্সে বেশ কিছু শিক্ষা সংস্কার করেন সেগুলি হল - 

a) ফ্রান্সে বেশ কিছু মাধ্যমিক, চিকিৎসা, কারিগরী, আইন, শিক্ষক-শিক্ষন বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 

b) 29 টি লাইসি প্রতিষ্ঠা করেন। 

c) ‘University of France’ প্রতিষ্ঠা করেন। 

iv) ধর্মীয় সংস্কার - নেপোলিয়ন পোপ সপ্তম পায়াসের সঙ্গে যে চুক্তি করেন তা ধর্ম মীমাংসা চুক্তি নামে পরিচিত। এতে বলা হয় -

a) পোপ ফরাসী গির্জা ও সম্পত্তির জাতীয়করণ মেনে নেন। 

b) স্থির হয় যে সরকার যাজকদের নিয়োগ করবে এবং পোপ তাদের স্বীকৃতি দেবে।

v) আইন বিষয়ক সংস্কার - ‘কোড নেপোলিয়ান’ এতে বলা হয় -

a) সামন্ততন্ত্রের বিলুপ্তি লিখতে হবে। 

b) ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের স্বীকৃতি। 

c) আইনের দৃষ্টিতে সাম্য। 

d) সরকারি চাকরিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ ইত্যাদি। 

vi) মূল্যায়ন - নেপোলিয়ান তার সংস্কারের দ্বারা ফ্রান্সের শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনেন।  ডেভিড টমসন বলেছেন নেপোলিয়নের শাসন শুধু প্রজাহিতৈষী  ছিল না তা বর্তমান কালের একনায়ক তন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি মানবিক ছিল। 


3. নেপোলিয়ন রাশিয়া অভিযান কেন করেন ?

টিলসিটের সন্ধির (১৮০৭ খ্রি:) দ্বারা ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেও এই সম্পর্ক শীঘ্রই ভেঙে যায়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান ১৮১২ খ্রি: রাশিয়া আক্রমণ করেন। কারণ -

i) টিলসিটের সন্ধির ত্রুটি - টিলসিটের সন্ধিতে নেপোলিয়ান তুরস্ক ও সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। ফলে রুশ জার ক্ষুব্ধ হন। 

ii) ওল্ডেনবার্গ দখল - মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করায় নেপোলিয়ান রুশ জারের ভগ্নিপতি ওল্ডেনবার্গের ডিউকের রাজ্যটি দখল করে নেয় -ফলে জার অত্যন্ত ক্ষুব্দ হন। 

iii) ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার ঘনিষ্ঠতা - নেপোলিয়ান অষ্ট্রিয়ার হ্যাপসবার্গ বংশীয় রাজকন্যা মেরি লুইসাকে বিবাহ করলে রুশ জার আতঙ্কিত হন যে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়া মিলিত হয়ে রাশিয়ার ক্ষতি করবে। 

iv) মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা - রাশিয়া প্রথমে নেপোলিয়ানের মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও ১৮১০ খ্রি: এই ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করে। ফলে রাশিয়ার ওপর নেপোলিয়ান ক্ষুব্ধ হন। 


4. নেপোলিয়ানের রাশিয়া অভিযানের বিবরণ দাও। 

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান 1812 খ্রিস্টাব্দের 26 শে জুন, তার মহান সেনাদলের 6 লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে রাশিয়া আক্রমন করেন। 

রাশিয়া আক্রমনের বিবরণ -

i) পোড়ামাটি নীতি - রুশ বাহিনী সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে। তারা রাস্তাঘাট, সেতু ও জলপথ ধ্বংস করে, মাঠের ও গোলার ফসল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এবং পানীয় জলে বিষ মিশিয়ে দেয়। এটি পোড়ামাটি নীতি নামে পরিচিত। এর ফলে ফরাসি বাহিনী রাশিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে সংকটের সম্মুখীন হয়। 

ii) বোরোডিনোর যুদ্ধ - সেনাপতি কুতুজবের নির্দেশে রুশ বাহিনী ফরাসি বাহিনীকে প্রতিরোধ করলে বোরোডিনোর যুদ্ধে নেপোলিয়ান তাদের পরাজিত করেন। 

iii) মস্কো অভিযান - বোরোডিনোতে জয়লাভের পর ফরাসি বাহিনী 75 মাইল দুর্গম পথ অতিক্রম করে মস্কোয় পৌঁছায়। পথে খাদ্যাভাব, তীব্র শীত, বাসস্থানের অভাব ও মহামারিতে আক্রান্ত প্রচুর ফরাসি সৈন্যের মৃত্যু হয়। 

iv) রাশিয়া ত্যাগ - এই সময় রাশিয়ায় তীব্র শীত, তুষারপাত, ঝড়, চরম খাদ্যাভাব ও চাইফাস নামক জ্বরের প্রকপ শুরু হলে দিশেহারা নেপোলিয়ান তার মহান সেনাদলের অবশিষ্ট সেনাদের দ্রুত স্বদেশে ফেরার নির্দেশ দেন। 

v) স্বদেশে ফেরা - স্বদেশে ফেরার পথেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যজন্তুর আক্রমণ ও গেরিলা রুশ বাহিনীর আক্রমণে প্রচুর ফরাসি সেনার মৃত্যু হয়। মাত্র 30-50 হাজার সেনা দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। 


5. টীকা লেখ - কোড নেপোলিয়ান। 

নেপোলিয়ানের সর্বাপেক্ষা গৌরবময় কীর্তি হল “কোড নেপোলিয়ান”। 

i. আইনসমূহ রচনা - নেপোলিয়ানের উদ্যোগে গঠিত কমিশন 1804 খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের জন্য নতুন আইনসমূহ রচনা করেন। এটি “কোড নেপোলিয়ান” নামে পরিচিত। 

ii. আইনসমূহের শ্রেণিবিভাগ - কোড নেপোলিয়ানে মোট 2287 টি আইন ছিল। এর আইনগুলি মূলত তিনভাগে বিভক্ত ছিল।  যথা - দেওয়ানি আইন, ফৌজদারি আইন এবং বাণিজ্যিক আইন। 

iii. বৈশিষ্ট্য - 

a. আইন এর চোখে দেশের সকল নাগরিকের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। 

b. সামন্ততান্ত্রিক অসাম্যের বিলোপ ঘটানো হয়। 

c. যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। 

d. সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

e. অপরাধের শাস্তি হিসেবে জরিমানা, কারাদন্ড, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, মৃত্যুদন্ড প্রভৃতি ব্যবস্থা করা হয়। 

iv. ত্রুটি - “কোড নেপোলিয়ানের বিভিন্ন ত্রুটি ছিল। যেমন - এতে সমাজে নারীর মর্যাদা হ্রাস করা হয়। স্ত্রীর উপর স্বামীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা হয়। শ্রমিক শ্রেণি তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। 


6. মহাদেশীয় অবরোধ বলতে কী বোঝ। 

ভূমিকা - নেপোলিয়ান ইউরোপে ইংরেজ আধিপত্য বিনষ্ট করার জন্য ইংল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল নৌ শক্তিতে ইংল্যান্ড ছিল অপ্রতিহত এবং তার সামুদ্রিক আধিপত্য নেপোলিয়ানের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এই অবস্থায় ইংল্যান্ডকে সমুচিত শিক্ষা দিতে নেপোলিয়ান মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। 

কারন - 1806 খ্রি: মধ্যে নেপোলিয়ান ইংল্যান্ড বাদে সমগ্র ইউরোপীয় স্থলভাগের ভাগ্য বিধাতা হন। টিলসিটের সন্ধির পর ইউরোপের উপর তাঁর আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ইংল্যান্ডের অপরাজেয় নৌশক্তিকে দমন করার জন্য নেপোলিয়ান ইউরোপের ভূখণ্ডে যে ব্যবস্থা চালু করে তা “মহাদেশীয় অবরোধ” প্রথা নামে পরিচিত। এই প্রথার দ্বারা নেপোলিয়ান ইংল্যান্ডের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ করতে চেয়েছিল। অর্থাৎ ইংল্যান্ডকে হাতে মারতে না পেরে ভাতে মারার পরিকল্পনা করেন। 

বিভিন্ন ডিক্রি ঘোষণা - মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা কার্যকরী করতে নেপোলিয়ান  1806-1810 খ্রি: মধ্যে বেশ কয়েকটি ডিক্রি জারি করেন। 1806 খ্রি: বার্লিন ডিক্রি জারি করে ইংল্যান্ডে তৈরি কোনো জিনিসের ইউরোপের বাজারে প্রবেশ নিষেধ করেন 1807 খ্রি:, মিলান ডিক্রি জারি করে সমগ্র ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবরোধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ড ও তার মিত্রদেশ বা তার উপনিবেশের কোনো বন্দরের নিরপেক্ষ দেশের জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। 1807 খ্রিষ্টাব্দে ওয়ারশ ডিক্রি ও 1810 খ্রি: ফন্টেন ব্লু ডিক্রির মাধ্যমে ফ্রান্স অধিকৃত অঞ্চলে কোনো জাহাজে ব্রিটিশ পণ্য এলে তা পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড মহাদেশীয় অবরোধের প্রত্যুত্তরে  1807 খ্রিষ্টাব্দে  “ অডারস ইন কাউন্সিল” জারি করে ফ্রান্স ও তার মিত্রদেশের ওপর অবরোধ ঘোষণা করেন। এছাড়া কোনো নিরপেক্ষ দেশ যদি ফ্রান্সে পণ্য পাঠাতে চায় তবে সেই জাহাজকে আগেই ইংল্যান্ডের কোনো বন্দরে এসে লাইসেন্স ফি অনুমতি নিতে হবে। 

ফলাফল - মহাদেশীয় অবরোধ প্রথার ফলে ইউরোপে ব্যবসা -বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দুর্লভ ও দুর্মূল্য হওয়ায় নেপোলিয়ানের প্রতি সমগ্র ইউরোপে এক ঘৃণার সৃষ্টি হয়। ইংল্যান্ড নৌশক্তিতে বলিয়ান হয়। নেপোলিয়ানের যে উদ্দেশ্য ছিল, তা ব্যর্থ হয়েছিল এই অবরোধ কার্যকর করার মতো নৌশক্তি নেপোলিয়ানের ছিল না। এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ান পোপের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। পর্তুগাল আক্রমণ করে বিফল হন, রাশিয়া আক্রমণ করে তার বিখ্যাত গ্র্যান্ড আর্মি হারান। ফলে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা তার পতনের পথ সুগম করে। এই কারনে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথাকে তার একটি মহা ভুল বলে মনে করা হয়।

 

7. নেপোলিয়ানের পতনের কারনগুলি লেখ। 

উঃ - ভূমিকা - নেপোলিয়ান অসামান্য প্রতিভাবলে প্রায় সমগ্র ইউরোপব্যাপী এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করলেও তার সাম্রাজ্য খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। 1807 খ্রি: টিলসিটের সন্ধির মাধ্যমে তাঁর সাম্রাজ্যের চরম বিস্তার ঘটলেও এর পর থেকেই নেপোলিয়ানের পতনের সূত্রপাত হয়েছিল। তাঁর পতনের পিছনে যে গুরুত্বপূর্ণ কারনগুলি ছিল। সেগুলি হল -

1. অপরিমিত উচ্চাকাঙ্খা : সম্রাট নেপোলিয়ানের উচ্চাকাঙ্খা ছিল অপরিমিত। সামরিক শক্তির জোরে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের যতই বিস্তৃতী ঘটান ততই তাঁর উচ্চাকাঙ্খা বাড়তে থাকে। এই বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে যে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয় তা তাঁর ছিল না। তিনি সমগ্র ইউরোপের অধিশ্বর হতে চেয়েছিলেন। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি সকল দেশের সাধারণ শত্রুতে পরিণত হন। 

2. সাম্রাজ্যের বিশালতা : নেপোলিয়নের সাম্রাজ্যের বিস্তার ছিল বিশাল। প্রায় সমগ্র ইউরোপ তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বিশাল সাম্রাজ্যের ঐক্য দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। এছাড়া এরূপ বিশাল সাম্রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য উপযুক্ত সংগঠন ও পরিকাঠামো তিনি গড়ে তুলতে পারেননি। 

3. মস্কো অভিযান - মস্কো অভিযান ছিল নেপোলিয়নের এক ভ্রান্ত পদক্ষেপ। রাশিয়া আক্রমণ করে তিনি সে দেশের জনগণের কাছ থেকে এক বিরাট জাতীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল প্রচন্ড শীত ও খাদ্যাভাব। ফলে নেপোলিয়ানের ‘গ্রান্ড আর্মি’ প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। এই যুদ্ধে পরাজয় তার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। 

4. মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা - নেপোলিয়নের পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা। এটি ছিল ইংল্যান্ডকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে এক অর্থনৈতিক অবরোধ পরিকল্পনা কিন্তু এই ব্যবস্থাকে কার্যকরি করতে গিয়ে তাঁকে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে হয়েছিল। সকল দেশের জাতীয় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হন। এই অবরোধ কার্যকর করার মতো নৌশক্তিও তার ছিল না। এইভাবে মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা তাঁর পতনে অনুঘটকের কাজ করেছিল। 

5. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন - নেপোলিয়ান ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যেমন - জার্মানি, স্পেন, রাশিয়া, ইটালি, পোল্যান্ড জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রচার করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাম্রাজ্যবাদী অভিযান ও স্বৈরাচারী শাসনের জন্য এই দেশগুলির জনগণ তারই প্রচারিত জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। 


8. নেপোলিয়ান কীভাবে ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করেন ?

- ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসানের পর ডাইরেক্টরি শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা ও ক্রমাগত বৈদেশিক আক্রমনে ফ্রান্সের জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। সেই সময় নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তার অভাবনীয় সামরিক শক্তির দ্বারা ফ্রান্সকে রক্ষা করেন এবং ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করেন। একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও নেপোলিয়ান নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে যে কৃতিত্বগুলি দেখিয়েছিলেন তা নিম্নে আলোচনা করা হল। 

i. জ্যাকোবিন দলের সদস্য হিসাবে নিযুক্ত নেপোলিয়ান ব্রিটিশ অধিকৃত ফ্রান্সের তুলো বন্দর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পুনরুদ্ধার করেন। এর ফলে তাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। 

ii. উগ্র রাজতান্ত্রিক সমর্থকরা যখন ফরাসি জাতীয় সভা আক্রমন করে, তখন নেপোলিয়ান আক্রমণকারীদের নিরস্ত্র করে জাতীয় সভা রক্ষা করেন। এর পুরস্কারস্বরূপ নেপোলিয়ানকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। ফলে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীন সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব নেপোলিয়ানের হাতে চলে যায়। 

iii. অষ্ট্রিয়া, সার্ডেনিয়া ও মিশরের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে নেপোলিয়ান সফল হন এবং নিজের ক্ষমতাও বৃদ্ধি ঘটায়। 

iv. অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলার সুযোগে তিনি ডাইরেক্টরি শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটান এবং কনসুলেট নামে এক নতুন শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। কনসুলেট শাসনে তিনজন কনসুলেটের মধ্যে নেপোলিয়ান হয়ে ওঠেন সর্বশক্তিমান। 

এভাবেই প্রথমে কনসুলেট হিসাবে দশ বছরের জন্য এবং পরে (1804 খ্রি:) সারাজীবনের জন্য নিজেকে কনসুলেট হিসাবে ঘোষণা করেন। এভাবেই তিনি ফ্রান্সের সর্বময় সম্রাট হয়ে ওঠেন। 


9. কোড নেপোলিয়ন কী বা নেপোলিয়নের আইনসংহিতা কবে পাশ হয় ? এই আইনসংহিতায় কী বলা হয় ?

কনসুলেট হিসাবে নেপোলিয়ান ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করার পর সেখানে বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত অসংগঠিত আইনগুলির সংস্কারে মনোযোগ দেন। অসংগঠিত আইনগুলিকে একত্রিত করার জন্য তিনি আইনজীবীদের নিয়ে এক সমিতি গঠন করেন। এই আইনজীবীরা মোট 84 টি অধিবেশনের মাধ্যমে ফ্রান্সে নির্দিষ্ট কিছু আইনবিধি সংকলন করেন (1807) একেই কোড নেপোলিয়ান বা আইনসংহিতা বলা হয়। 

কোড নেপোলিয়ানের বৈশিষ্ট্য- নেপোলিয়নের আইন সংহিতায় 2287 টি বিধি সংকলিত হয়। এই সংহিতাকেই প্রধান তিন ভাগে বিভক্ত ছিল - দেওয়ানি আইন, ফৌজদারি আইন, ও বাণিজ্যিক আইন। ফ্রান্সের জনগণকে সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য -

i. আইনের চোখে সকলের সাম্যতা দেওয়া হয়। 

ii. যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়। 

iii. সামন্ততান্ত্রিক বৈষম্যের বিলোপ ঘটানো হয়। 

iv. ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

সীমাবদ্ধতা - কোড নেপোলিয়নে রোমান আইনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই আইনসংহিতায় নারীদের অধিকারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। এছাড়াও শ্রমিকদের অধিকারকেও এই সংহিতায় গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। 


10. ধর্ম মীমাংসা চুক্তি কি ? এতে কি বলা হয় ?

‘সিভিল কনস্টিটিউশন অফ দ্যা ক্ল্যার্জি’ আইনের দ্বারা চার্চের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে চার্চকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ফলে রাষ্ট্রের সাথে পোপের বিরোধ বাধে। নেপোলিয়ান ফ্রান্সের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর পোপ সপ্তম পায়াসের সাথে যে চুক্তির মাধ্যমে এই বিরোধের অবসান ঘটান, তাকেই ধর্মমীমাংসা চুক্তি বলে। এই চুক্তি অনুযায়ী ঠিক হয় -

i. রোমান ক্যাথোলিক ধর্মমত ও চার্চগুলিকে ফ্রান্স স্বীকৃতি দেবে। 

ii. ফরাসি সরকার যাজকদের বেতন দেবে। 

iii. ক্যাথোলিকরা সাধারণভাবে ধর্মাচারণ করতে পারবে। 

iv. যাজকদের উপর বিশপদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। 

v. সরকার মনোনীত যাজকদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে পোপ। 

vi. বিপ্লবের সময় চার্চ ও তার সম্পত্তি জাতীয়করণের যে নীতি গ্রহন করা হয়েছিল তা পোপ মেনে নেবে। 

এই চুক্তির ফলে রাষ্ট্রের সাথে পোপের যেমন বিরোধের অবসান ঘটে তেমনই ক্যাথোলিক চার্চ রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফ্রান্সে ধর্মসহিষ্ণুতার আদর্শ গৃহীত হয়। ঐতিহাসিক কোবান তাই যথার্থই বলেছেন কনকডার্ট বা ধর্মচুক্তি ছিল নেপোলিয়নের একটি মহান জয়। 


11. নেপোলিয়নের শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কারগুলি কি ছিল ?

কনসাল রূপে ফ্রান্সের শাসনভার গ্রহণ করার পর 1804 খ্রি: নেপোলিয়ন নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। শাসন ভার গ্রহণ করে তিনি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে অর্থনীতি, আইন, বিচার, শিক্ষা প্রভৃতির উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

অর্থনৈতিক সংস্কার- দেশের অর্থনীতিকে সুগঠিত করার উদ্দেশ্যে -

i. ‘ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। (1800 খ্রি:)

ii. অর্থব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য সোনা ও রুপার মুদ্রা চালু করেন। 

iii. সরকারি দপ্তরে ব্যয় কমিয়ে অডিটের ব্যবস্থা করেন। 

iv. ন্যূন কর না চাপিয়ে পুরানো কর আদায়ের উপর জোর দেন। 

v. সবাইকে আয়কর দিতে বাধ্য করেন। 

vi. ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন, স্টক এক্সচেঞ্জ গঠন করেন, বন্দরের সংস্কার করেন।

শিক্ষা সংস্কার - ফ্রান্সের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য -

i. প্রতিটি পৌরসভায় একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরী করেন। 

ii. সামরিক শিক্ষার জন্য 29টি লাইসি তৈরি করেন। 

iii. চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য অনেকগুলি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 

iv. উচ্চশিক্ষার জন্য ইমপেরিয়াল ইউনিভারসিটি অফ ফ্রান্স তৈরি করেন। 

শাসনতান্ত্রিক সংস্কার - প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ফ্রান্সকে 

i. 83 টি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রদেশগুলিকে 547 টি জেলাতে ভাগ করেন। প্রদেশ ও জেলাগুলির যাবতীয় ক্ষমতা প্রিফেক্ট ও সাবপ্রিফেক্টদের হাতে দেওয়া হয়। 

ii. আইন পরিষদকে চারটি কক্ষে ভাগ করেন। আইন পরিষদের ক্ষমতাকে চারটি কক্ষের মধ্যে ভাগ করে দেন। 

iii. প্রাদেশিক ও পৌরসভাগুলোর স্বায়ত্তশাসনের অধিকার হ্রাস করা হয়। 

iv. কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচনের পরিবর্তে নিজের পছন্দের মতো কর্মচারী নিয়োগ শুরু হয়। 


12. নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ কতটা রক্ষা করতে পেরেছিলেন বা “আমি বিপ্লবের সন্তান, আমি বিপ্লবকে ধ্বংস করেছি” এই বক্তব্যের যুক্তিকতা দেখাও। 

কনসাল হিসাবে ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করলেও নেপোলিয়ন বিপ্লবী আদর্শকে সর্বক্ষেত্রে বজায় রাখতে পারেনি। তিনি বুঝেছিলেন ফ্রান্সের জনগণকে বিপ্লবের আদর্শ না দিলে ফরাসি জনগণ তাকে সম্রাট হিসাবে মানবে না। তাই সাম্য ও মৈত্রীকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি কতকগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। 

বিপ্লব রক্ষাকারী -

i. ফ্রান্সের সংবিধান সভা কর্তৃক আরোপিত নিয়মগুলি বহাল রাখেন। - সামন্তপ্রথা, ভূমিদাস প্রথা, সামন্তকর, বেগারশ্রম, ধর্মকর বিলোপ ঘটান। 

ii. কোড নেপোলিয়ন চালু করে আইনের চোখে সমতার নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। 

iii. ফরাসি বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। 

iv. ফ্রান্স ছাড়াও ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপ্লবের আদর্শকে ছড়িয়ে দেন। 

বিপ্লব ধ্বংসকারী - বিপ্লবের সন্তান হয়েও নেপোলিয়ন এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যার ফলে তাকে বিপ্লবের ধ্বংসকারীও বলা হয়। 

i. নেপোলিয়ান নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করার মাধ্যমে ফ্রান্সে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটান। 

ii. বিপ্লবের অন্যতম দাবি ‘স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন। মানুষের বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করেন। রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ করে দেন। 

iii. নেপোলিয়ানের শিক্ষানীতি আসলে শিক্ষিত সমাজকে সম্রাট ও রাষ্ট্রের অনুগত করে তুলতে চেয়েছিল। 

iv. ক্যাথোলিক চার্চের ক্ষমতাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

মূল্যায়ন - এইকারনেই ঐতিহাসিক ট্রটস্কি, লেফেভর প্রমুখের মতে নেপোলিয়ন ছিল বিপ্লবের ধ্বংসকারী। 


13. মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কি ? এই ব্যবস্থা ব্যর্থ হয় কেন ?

নেপোলিয়ান আর্থিক দিক থেকে ইংল্যান্ডকে কোনঠাসা করার জন্য সে দেশের বাণিজ্যকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যে ব্যবস্থা চালু করেন, তা মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা নামে পরিচিত। সমগ্র মহাদেশে নেপোলিয়ন এই সামুদ্রিক অবরোধ করেছিলেন বলে একে অবরোধ বা কন্টিনেন্টাল সিস্টেম বলে। মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য তিনি যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছিলেন তা হল -

i. 1806 খ্রি: বার্লিন ডিক্রি চালু করে বলেন ইউরোপের সমস্ত বন্দরে ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তিনি আসা করেছিলেন ইংল্যান্ড দুর্বল হয়ে পড়লে ফরাসি অধীনতা মেনে নেবে। 

ii. নেপোলিয়ান 1807 খ্রি:  মিলান ডিক্রি জারি করে ঘোষণা করেন ইংল্যান্ড বা তার উপনিবেশের কোনো বন্দরে নিরপেক্ষ দেশের জাহাজ প্রবেশ করলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। 

iii. মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য নেপোলিয়ান ওয়ারশ ডিক্রি এবং ফন্টেন ব্লু ডিক্রি জারি করেন। এতে বলা হয় নির্দেশ অমান্যকারী সকল জাহাজকে প্রকাশ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। 

ব্যর্থতার কারন - 

নেপোলিয়ানের এই মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। এর কারনগুলি হল - 

i. মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা চালু করার মতো শক্তিশালী নৌবাহিনী ফ্রান্সের ছিল না। 

ii. অবরোধ ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে ইংল্যান্ড থেকে রপ্তানীকৃত দ্রব্যের দাম ইউরোপে প্রচুর পরিমানে বেড়ে যায়। এই দ্রব্যগুলি সরবরাহ করা ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। 

iii. ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইংল্যান্ডজাত দ্রব্যের প্রচুর চোরা চালান শুরু হয়। যা প্রতিরোধ করা নেপোলিয়নের পক্ষে সম্ভব ছিল না। 

শেষ পর্যন্ত নেপোলিয়ানের এই অবরোধ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়।1813 খ্রি: তিনি এই অবরোধ ব্যবস্থা প্রত্যাহার করেন। 


14. নেপোলিয়নের স্পেন আক্রমনের কারন কি ছিল ? ফরাসিরা স্পেনের কাছে যুদ্ধে পরাস্ত হয় কেন ? বা নেপোলিয়ান স্পেনীয় ক্ষত বলতে কি বোঝো ?

মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা কার্যকর করার উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ান স্পেন আক্রমন করেন। নেপোলিয়ানের স্পেন আক্রমনের কারনগুলি হল -

i. স্পেনের নৌবাহিনী দখল করে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর জন্য। 

ii. নেপোলিয়ান মনে করতেন নিজের শাসনক্ষমতা বজায় রাখতে গেলে স্পেনকে দখলে আনা প্রয়োজন। 

iii. নেপোলিয়ান জানতে পারেন স্পেন ও প্রাশিয়া ফ্রান্স আক্রমনের পরিকল্পনা করছে। তাই তিনি আগে আগেই স্পেন দখলের জন্য স্পেন আবিষ্কার করেন। 

নেপোলিয়ানের ব্যর্থতা- স্পেনের জনগণ নেপোলিয়ানের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইংল্যান্ড ও পোর্তুগাল এই যুদ্ধে যোগ দেয়। স্পেন, ইংল্যান্ড ও পোর্তুগালের সম্মিলিত শক্তির কাছে ফরাসি বাহিনী পরাজিত হয়। 

নেপোলিয়ানের পরাজয়ের কারন হল -

i. স্পেনের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীকে সমস্যায় ফেলে। 

ii. ফরাসি বাহিনী স্পেনে প্রবেশ করলে খাদ্যাভাব ও যোগাযোগের সমস্যার সম্মুখীন হয়। 

iii. স্পেনীয়রা গেরিলা যুদ্ধনীতির দ্বারা ফরাসি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে। 

vi. স্পেনের জাগ্রত জাতীয়তাবাদ নেপোলিয়নের বাহিনীকে পরাস্ত করে। 

1813 খ্রি: নেপোলিয়নের বাহিনী এই যুদ্ধে পরাস্ত হয়। নেপোলিয়ন স্পেন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এরপর তিনি আক্ষেপ করে বলেন-”স্পেনীয় ক্ষত আমার পরাজয়ের মূল কারণ” 


15. নেপোলিয়ান কেন রাশিয়া আক্রমন করেন ? এর গুরুত্ব কি ছিল ?

ফ্রিডল্যান্ডের যুদ্ধে রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার নেপোলিয়ানের কাছে পরাজিত হয়ে টিলসিটের সন্ধির স্বাক্ষর করেন। কিন্তু রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই সন্ধি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।1812 খ্রি: নেপোলিয়ান পুনরায় রাশিয়া আক্রমন করেন। নেপোলিয়ানের রাশিয়া আক্রমনের কারনগুলি হল -

i. টিলসিটের সন্ধি অনুযায়ী রাশিয়ার জার আশা করেছিলেন নেপোলিয়ান সুইডেন ও তুরস্কের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করবেন। কিন্তু নেপোলিয়ান তা করেনি। 

ii. নেপোলিয়ান প্রাশিয়া অধিকৃত পোল্যান্ডের অংশ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করেন। এতে রাশিয়ার ধারণা হয় নেপোলিয়ান স্বাধীন পোল্যান্ড রাষ্ট্র গঠন করার চেষ্টা করছেন। 

iii. নেপোলিয়ানের কথা মতো রাশিয়া মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা মেনে নেয়। এর ফলে রাশিয়ার প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়। এঅবস্থায় রাশিয়ার জার রাশিয়াকে পুনরায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। 

iv. মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা অমান্য করার জন্য নেপোলিয়ান ওল্ডেনবার্গ দখল করেন। এই ঘটনায় রুশ অভিজাতরা নেপোলিয়ানের প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ নেপোলিয়ান পুনরায় রাশিয়া আক্রমন করেন। 

তাৎপর্য- i.নেপোলিয়ানের রাশিয়া আক্রমনের ব্যর্থতা তার অপরাজেয় সত্ত্বাকে আঘাত এনেছিল। 

ii. নেপোলিয়ান রাশিয়ার কূটনীতির কাছে পরাজিত হয়ে তার বহু সৈন্যক্ষয় হয়েছিল। 

iii. নেপোলিয়ানকে পরাজিত হতে দেখে তার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড, প্রাশিয়া সহ অন্যান্য দেশ শক্তিজোট গঠন করে। 

iv. ফ্রান্সের অধীনস্ত দেশগুলিতে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়তে শুরু করে। 


16. শতদিবসের রাজত্ব কী? শতদিবসের রাজত্বের অবসান কীভাবে হয় ?

- 1814 খ্রি: নেপোলিয়ন শত্রুপক্ষের হাতে পরাজিত হন এবং তাকে এলবা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। কিন্তু নেপোলিয়ন হতাশায় ভেঙে না পড়ে ফ্রান্সের ক্ষমতা পুনঃদখলের পরিকল্পনা করেন। নেপোলিয়নের নির্বাসনের পর অষ্টাদশ লুই সিংহাসনে বসেন কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনগণ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। বুরবোঁ রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে দেশত্যাগী ফরাসি অভিজাতরা পুনরায় দেশে ফিরে আসে এবং সম্পত্তি পুনঃউদ্ধারের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে নেপোলিয়ন বিরোধী শক্তিজোট ফ্রান্সসহ ইউরোপে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। এই সুযোগে নেপোলিয়ন 1815 খ্রি: পুনরায় কিছু সৈন্যবাহিনী নিয়ে ফ্রান্সে ফিরে আসেন এবং সিংহাসন দখল করেন। এইসময় তিনি মোট 100 দিন রাজত্ব করেন। এই ঘটনাকেই শতদিবসের রাজত্ব বলা হয়। 

রাজত্বের অবসান - নেপোলিয়নের ফিরে আসার পর মিত্র পক্ষ তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিন দিক থেকে ফ্রান্সে আক্রমন করেন। একদিকে ছিল ব্রিটিশ ও প্রাশিয়ার সেনাবাহিনী অন্যদিকে রাশিয়া জার আলেকজান্ডারের নেতৃত্বে রুশ বাহিনী এবং অন্যদিকে ছিল অষ্ট্রিয়ার বাহিনী। নেপোলিয়ন একের পর এক যুদ্ধনীতি অনুসরণ করেন কিন্তু ওয়াটারলু যুদ্ধে শেষপর্যন্ত চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন। নেপোলিয়নকে শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স থেকে 5000 মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। 1821 সালে 52 বছর বয়সে নেপোলিয়ন সেখানেই মারা যায়। 


17. নেপোলিয়নের পতনের কারণ কী ছিল ?

একজন সামান্য সৈনিক থেকে ফ্রান্সের শাসক হিসাবে নেপোলিয়ন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে  পেরেছিলেন। তিনি সমগ্র ইউরোপে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার এই সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। এর কারন ছিল -

i. সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি - নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ছিল সামরিক শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তার সাম্রাজ্যের প্রতি জনগনের সমর্থন ছিল না। যে জাতিকে তিনি জয় করেছিলেন তারাও নেপোলিয়নের প্রতি ঘৃণার ভাব পোষণ করতেন। 

ii. স্বৈরাচারী শাসন - নেপোলিয়ন ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ রক্ষার পরিবর্তে স্বৈরাচারী শাসনের সূচনা করেন। বিপ্লবের সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার আদর্শ তিনি বজায় রাখেনি, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের সূচনা করেন। 

iii. মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা - নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে বলপ্রয়োগ করে। ফলে সেই সব দেশ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়। 

iv. ধর্ম বিবাদ- ধর্মমীমাংসা চুক্তি অনুযায়ী প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্ষুব্ধ হয়। নেপোলিয়ন পোপকে বন্দি করার ফলে ক্যাথোলিক ধর্মাবলম্বীরা তার প্রতি রুষ্ঠ হয়। 

v. রাশিয়ায় ব্যর্থতা- নেপোলিয়ন স্পেন ও রাশিয়া আক্রমণ করে পরাস্ত হয়। ফলে নেপোলিয়ন বিরোধী শক্তিজোট ক্রমশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। 

vi. জাতিসমূহের যুদ্ধ- নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপের জাতিসমূহ যে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়, তা প্রতিরোধ করা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সম্ভব হয়নি। 

vii. ইংল্যান্ডের বিরোধিতা - নৌশক্তিতে বলিয়ান ইংল্যান্ডকে জব্দ করতে গিয়ে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সামরিক শক্তিকে বিধ্বস্ত করে। 

এসব কারণে নেপোলিয়ন 1814 খ্রি: পরাজিত হয় কিন্তু তিনি পুনরায় সিংহাসন দখল করলে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে ওয়াটারলু যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে নেপোলিয়ন চুরান্তভাবে পরাজিত হয়। 



Ratings
No reviews yet, be the first one to review the product.
Click to send whatsapp message
Copywrite 2025 LRNR